১৮৯৩ সালের ৬ই অক্টোবর মেঘনাদ সাহার জন্ম হয় ঢাকার অদূরে শ্যাওড়াতলী নামক গ্রামে। পিতা জগন্নাথ সাহার দুই ছেলে ও দুই মেয়ের পর মেঘনাদ সাহা ছিলেন পঞ্চম সন্তান। মেঘনাদ সাহার জন্মের রাত ছিল ঝড় আর দুর্যোগের। তখনকার সময়ে আঁতুড় ঘরটি থাকতো মূল বাড়ী থেকে একটু দূরে। সেদিন বৃষ্টি আর বিদ্যুতের ঘনঘটার মধ্যে দমকা হাওয়ায় আঁতুড় ঘরের চাল উড়ে গেল। ঝড়-বৃষ্টির বিরাম নেই দেখে বৃষ্টির দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য শিশুর ঠাকুমা তার নাম রাখলেন মেঘনাথ। পরে এটি হয়ে যায় মেঘনাদ। (শান্তিময় ও এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়, ১৯৫৯)
বিজ্ঞানসাধক মেঘনাদ সাহার ব্যক্তিবিশেষের ঊর্দ্ধে গিয়ে নিজেই একজন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের ন্যায় বিরাজমান। আজ তাঁর জন্মদিনে এখানে আমি মেঘনাদ সাহার প্রতিষ্ঠান স্থাপনা, রাজনৈতিক জীবন এবং অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন নিয়ে তার মতাদর্শ আলোচনা করবো।
(১) কলকাতায় ফেরা ও এক নতুন প্রতিষ্ঠানের শুভারম্ভ:
এলাহাবাদ ছেড়ে ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে ডঃ মেঘনাদ সাহা ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, ক্যালকাটাতে (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের পালিত অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। তখন সাহার কাছে দুটি প্রস্তাব এসেছিল – একটি কলকাতার পালিত অধ্যাপকপদ, অন্যটি বথের রয়াল ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এর অধ্যক্ষ পদ। তিনি বেছে নিলেন প্রথমটি। কলকাতা ফিরেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের সিলেবাসে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স পড়ানোর প্রস্তাব দেন এবং নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে একটি বিশেষ পেপার চালু করেন। পাশাপাশি কলকাতায় একটি নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর প্রতিষ্ঠান বানানোর পরিকল্পনা শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি দেশের আরো অনেক প্রমুখ বিজ্ঞানীদের সাথে ব্রিটেন, আমেরিকা, কানাডা-র বিভিন্ন গবেষণাগার ভ্রমণ করেন তিনি। ১৯৪৫ সালে তিনি যান রাশিয়াতে রাশিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের একটি অনুষ্ঠানে। এর আগে ১৯৩৬ সালের জুন মাসে তিনি যান ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এ যোগ দিতে।
সেখানে উপস্থিত ছিলেন পাঊলি, হাইজেনবার্গ, ম্যাক্স বর্ন, ওপেনহাইমার, নীলস বোর, হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা প্রমুখ খ্যাতনামা বিজ্ঞানী।
ভেবে দেখুন তখনকার দিনে এমন একটি প্রতিষ্ঠান বানানো খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। প্রয়োজন ফান্ডিং। তখন ১৯৩৯ থেকে ১৯৪১ এর মধ্যে তিনি জাতীয় পরিকল্পনা কমিটির মিটিং-এর সূত্রে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কাছে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সেই সময় ডঃ সাহা নেহেরুকে নিউক্লিয়ার শক্তির গুরুত্ব ও এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা দিতে থাকেন। প্রাথমিক সফলতা পেলেন ডঃ মেঘনাদ সাহা। জওহরলাল নেহেরুর উদ্যোগে তিনি ১৯৪১ সালে স্যার ডোরাব টাটা ট্রাস্ট থেকে ৬০ হাজার টাকা, ১৯৪২ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬০ হাজার টাকা, ১৯৪৩ সালে জি. ডি. বিড়লার কাছ থেকে পাঁচ বছরের জন্য ১২ হাজার টাকা করে গবেষণার জন্য ফান্ড সংগ্রহ করেন। ডঃ সাহা তাঁর ছাত্র বি. ডি. নাগচৌধুরীকে ১৯৩৮ সালে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ক্যালিফোর্নিয়াতে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। তিন বছর পর নাগচৌধুরী দেশে ফিরলে তাঁকে যোগ্য সহকারী হিসেবে পাশে নিয়ে দেশের প্রথম সাইক্লোট্রন বানানোর কাজে ব্রতী হন ডঃ সাহা। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তাঁর কাজের জন্য বিদেশ থেকে অনেক যন্ত্রাংশ পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠলো।
এরপর ১৯৪৭ সালে তিনি তাঁর নতুন প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রায় ৬ লাখ ২০ হাজার টাকা সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। এর মধ্যে জওহরলাল নেহেরু মাধ্যমে অনুদান হিসেবে পান ৭০,০০০ টাকা, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান ছিল ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুদান ২ লাখ টাকা। শেষমেশ ১৯৪৮ সালের ২১শে এপ্রিল তিনি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের। ১৯৫০ সালের ১১ই জানুয়ারী ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের বিল্ডিংয়ের উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আইরিন জোলিয়েট ক্যুরি (মাদাম ক্যুরি-র কন্যা)। (Pramod V. Naik, 2017)
(২) ডঃ মেঘনাদ সাহা ও অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন:
১৯৪৮ সালের ১৫ই এপ্রিল নবগঠিত ভারত সরকার “The Atomic Energy Act XXIX” লাগু করেন। সে বছরেরই ৯ই অগাস্ট গঠিত হয় “The Atomic Energy Commission”, যার চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত হন ডঃ হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা। কমিশনের অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন, ডঃ কে. এস. কৃষ্ণণ, ডঃ শান্তিস্বরূপ। অ্যাটমিক এনার্জি অ্যাক্টে বলা হল: এই কমিশন সম্পূর্ণ গোপনীয়তার সাথে কাজ করবে এবং কমিশনের চেয়ারম্যান “answerable directly to the Prime Minister.”
সম্ভবত এই সময়ে অ্যাটমিক এনার্জি অ্যাক্টের তীব্র সমালোচনা করেন ডঃ সাহা। পরবর্তীকালে একটি পত্রে তিনি জওহরলাল নেহেরুকে লেখেন: “I have been put to one humiliation after another. I have been asked to take orders from Bhatnagar, whom I consider a very poor scientist, and from Bhabha, who though a good scientist, but [he] is 18 years my junior and the conferment of enormous power on him has made him extremely bumptious. They would have throttled my scientific activities completely, but probably in your calmer moments, you think that I am not so bad as they represent me to you. So I have been given doles from time to time in order that my scientific efforts may not be completely throttled.” (Abha Sur, 2002)
জওহরলাল নেহেরু সাহার এই সমালোচনাকে “not only unjustified but completely lacking in objectivity and therefore most unscientific” বলে উড়িয়ে দেন। এর সঙ্গে জওহরলাল নেহেরু কটূক্তির সুরে বলেন: “If you attack the Government, surely you do not expect them to remain silent.” (Abha Sur, 2002)
ডঃ সাহা ও ডঃ ভাবার মধ্যে মতানৈক্য থাকলেও, গবেষণাক্ষেত্রে একে অন্যকে সাহায্যই করেছেন। ১৯৫৪ সালে ডঃ ভাবা অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের বাজেট থেকে ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের গবেষণাখাতে ৫০ লাখ টাকা দেবার প্রস্তাব রাখেন ডঃ সাহার কাছে। ডঃ সাহা সেই প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। (Pramod V. Naik, 2017)
(৩) রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ডঃ মেঘনাদ সাহা:
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের সাথে ডঃ মেঘনাদ সাহার সুসম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রে নেতাজীর দাদা শরৎচন্দ্র বোসের পরিচয় হয় ডঃ মেঘনাদ সাহার সাথে। শরৎচন্দ্র বোস ১৯৪৬ সালে প্রথম অন্তর্বর্তী ভারত সরকারের একজন সদস্য ছিলেন। তিনিই ডঃ মেঘনাদ সাহাকে পার্লামেন্টে যোগ দেবার জন্য উৎসাহ দিতে থাকেন। ডঃ মেঘনাদ সাহা ন্যাশনাল প্ল্যানিং, রিভার ভ্যালি ডেভলেপমেন্ট, শিল্পের আধুনিকীকরণ, শিক্ষার আধুনিকীকরণ-সহ বিভিন্ন বিষয়ে অনেক ধারণা দিয়েছিলেন, তাই দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে তাঁর পার্লামেন্টে যোগ দেওয়াটা আবশ্যিক বলে মনে করতেন শরৎচন্দ্র বোস। (Pramod V. Naik, 2017)
১৯৫২ সাল। দেশের প্রথম সাধারণ লোকসভা নির্বাচন। শরৎচন্দ্র বোস ততোদিনে পরলোকগমন করেছেন। শরৎচন্দ্র বোসের পত্নী বিভাবতী বোসের পরামর্শে উত্তর-পশ্চিম কোলকাতা থেকে বাম সমর্থিত নির্দলীয় প্রার্থী হলেন ডঃ সাহা।
যদিও ডঃ সাহা কমিউনিস্ট ভাবধারায় বিশ্বাস করতেন কিন্তু কখনো কোনো বামপন্থী সংগঠনের সদস্য হননি। বিপুল ভোটে জয়ী হন তিনি।
১৯৫২ থেকে আমৃত্যু ১৯৫৬ পর্যন্ত লোকসভার সদস্য ছিলেন তিনি।
লোকসভায় বেশ সক্রিয় এবং জনপ্রিয় বক্তা ছিলেন ডঃ মেঘনাদ সাহা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নদীপ্লাবণ ও বাঁধ পরিকল্পনা, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সমস্যা, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, নিউক্লিয়ার শক্তি প্রভৃতি বিষয়ে লোকসভায় আলোচনা করেছেন তিনি।
নিউক্লিয়ার শক্তি সংক্রান্ত প্রথম আলোচনা তিনি লোকসভায় করেন ১৯৫৪ সালের ১০ই মে। আলোচনার বিষয় “Peaceful uses of Atomic Energy.”। এই সংক্রান্ত পরবর্তী বিতর্কসভায় তিনি অংশগ্রহণ করেন ১৯৫৫ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারী।
১০ই মে-র বক্তব্যে ডঃ সাহা বলেন: “Any scientist, however great he might be, cannot do this work alone. In scientific work, sometimes we find that it is not an Einstein or a Newton who can solve any problem.
Sometimes the problem was solved by a man who may be a back-bencher. Scientific work was the result of co-operation of a large number of brains.
Sometimes, a suggestion or a method of work comes from persons who were considered not very prominent or very able. In the development of atomic energy work in America, we find, suggestions have been made by persons whose names we do not know, we have not known till the other day. The most prominent scientists who were there had made absolutely no contribution. I want our government to take all these matters into consideration and lay down a sound policy for the development of atomic energy in this country.” (Pramod V. Naik, 2017)
এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বলেন: “…An eminent Member of the other side, who used to be a great scientist, Prof. Meghnad Saha, but who drifted from the fields of science and has found no foothold elsewhere yet, told us many things, most of which I think are completely wrong. I have seldom come across a less scientific approach to a problem than that of Prof. Meghnad Saha, in fact, a less factual approach. I can only express my deep regret that such an eminent scientist should have fallen into such evil ways of thinking…” (Pramod V. Naik, 2017)
প্রত্যুত্তরে ডঃ সাহা কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ না করেই বিদ্রূপের ঢঙে বলেন: ‘…I may add that I have done very little in science, but my name would be remembered for some hundreds of years while some politicians here will go to unregretted oblivion in a few years’. (Pramod V. Naik, 2017)
অর্থাৎ, ডঃ মেঘনাদ সাহা অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন বা ডঃ ভাবার বিরোধী ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন অ্যাটমিক এনার্জি গবেষণার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো, আরো উন্নত ও মেধাবী গবেষক, মানবকল্যাণে এর ব্যবহার। তিনি সমালোচক ছিলেন চটজলদি সরকারী নীতি প্রণয়নের। তার মৃত্যু নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না, কারন মেঘনাদ সাহার মতো ব্যক্তিত্ত্বের মৃত্যু হয়না, তারা চির অমলিন থাকেন আমাদের হৃদয়ে। আসলে মেঘনাদ সাহা এক আন্দোলনের নাম, মেঘনাদ সাহা এক আধুনিক মতাদর্শ তথা ভাবধারার নাম, মেঘনাদ সাহা এক স্বতন্ত্র ভারতীয় বিজ্ঞানচেতনার প্রতীক।
© জয়ন্ত ঘোষ, ভূ-পদার্থবিদ্, জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া।
তথ্যসূত্র:
(১) মেঘনাদ সাহা, শান্তিময় ও এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ১৯৫৯।
(২) Meghnad Saha: His Life in Science and Politics, Pramod V. Naik, Springer, 2017.
(৩) Scientism and social justice: Meghnad Saha's critique of the state of science in India, Abha Sur, Historical Studies in the Physical and Biological Sciences, Vol. 33, No. 1 (2002), pp. 87-105.
(৪) Meghnad Saha: His Science and Persona through Selected Letters and Writings, Jibamitra Ganguly with Reminiscences of a Daughter Chitra Roy, Indian National Science Academy, 2019.